গ্যাসলাইটিং নিরব মানসিক নির্যাতন
‘তোমাকে দিয়ে একটা কাজও ঠিকমতো হয় না’, ‘তুমি এসবের কি বুঝো’, ‘একদম গজনী মেমোরি কোনকিছুই মনে থাকেনা’, ‘মেয়ে মানুষের বুদ্ধি কম’, ‘বৌ সংসার না করে চাকরি করলে সংসারের অবস্থা তো এমনই হবে’, ‘প্রেমের বিয়ে বলে কথা ঘরে অশান্তি তো হবেই’, ‘ছেলেরা এসব বিষয় কি বুঝবে’- এ জাতীয় কথাগুলো আমরা হরহামেশা আশেপাশে শুনে থাকি। আপাতদৃষ্টিতে খুব স্বাভাবিক ও আটপৌরে মনে হলেও বাক্যগুলো আমাদের অনুভূতিতে এক ধরণের মানসিক অস্বস্তি ও মন খারাপের জন্ম দেয়।
দাম্পত্য জীবন, অফিস, সমাজ ও পারিপার্শ্বিক নানা ক্ষেত্রে আমরা এই আচরণের শিকার হই। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এ ধরণের কথাবার্তাকে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং’। গ্যাসলাইটিং এক ধরণের প্রতারণা। কাউকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ম্যানিপুলেশন করে তার মনোবল ভেঙে দেয়া বা তার উপর কতৃত্ত্ব /নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করা। গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার ব্যক্তিদের ইচ্ছাকৃতভাবে বা পদ্ধতিগতভাবে মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়। তাদের স্মৃতিশক্তি, যোগ্যতা ও বিচারবুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
যাতে একসময় ভিকটিমের এমন ধারণা হয় যে তার চিন্তা, ধারণা, ভাবনা সব মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
‘গ্যাসলাইটিং’ মানুষকে নিয়ন্ত্রন করার এক অসুস্থ হাতিয়ার, অন্যায় ও হীন মনমানসিকতার পরিচয়। সাধারণত নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটির মানুষদের মধ্যে এই ধরণের আচরণ বেশী দেখা যায়। এক্ষেত্রে স্বার্থসিদ্ধির জন্য গ্যাসলাইটার বা শোষণকারী ভিকটিমের সুযোগ নিয়ে তার বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যাতে ভিকটিম আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে না পারে এবং অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রিয়জন বা কাছের মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত এমন ব্যবহার পেয়ে সে বিষণ্ণতায় ধাবিত হয় ও অসহায় বোধ করে।
১৯৩৮ সালের ৫ ডিসেম্বর লন্ডনের রিচমন্ড থিয়েটারে ‘গ্যাসলাইট’ নামে একটি মঞ্চনাটক প্রদর্শিত হয়। নাটকটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল কীভাবে একজন ব্যক্তি আরেকজন কতৃক কথা বা আচরণের মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। পরবর্তীতে ১৯৪০ সালে একই নামে একই ঘটনা অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রটি তেমন দর্শক সাড়া পায়নি। ১৯৪৪ সালে ‘গ্যাসলাইট’ নামে চার্লস বয়ার ও ইনগ্রিড বার্গম্যান অভিনীত আরেকটি মুভি মুক্তি পায়। এটি বেশ দর্শক প্রিয়তা পায়।
গল্পের কাহিনীতে দেখা যায়- গল্পের মুখ্য চরিত্র স্বামী তার বিত্তশালী স্ত্রী’কে তার বিভিন্ন কথা, চিন্তা ও ভাবনাকে মিথ্যা ও কল্পনা বলে বোঝানোর চেষ্টা করে। গ্যাসলাইটারের আলো কখনো বাড়িয়ে কখনো কমিয়ে স্ত্রীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কখনো ঘরের জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে রাখছে। স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলে বলছে আরে কি আবোলতাবোল বলছো ওসবতো ওখানেই ছিল। এভাবে দিনের পর দিন স্ত্রী’কে প্রভাবিত করার মাধ্যমে তাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন যে সে আসলেই অসুস্থ। পরে স্ত্রী’কে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তিনি তার স্ত্রী’র সম্পদের মালিক হন। মূলত এই চলচ্চিত্রের নাম থেকেই ‘গ্যাসলাইটিং’ শব্দটি এসেছে।
‘গ্যাসলাইটিং’ টার্মটি নতুন হলেও বর্তমানে এটি নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা ও ফোরামে বেশ আলোচনা হচ্ছে। স্টুডেন্ট, অফিসকর্মী, স্পাউজ, সন্তানদের উপর এটির প্রয়োগ লক্ষণীয়। এতে ভিকটিম বিষণ্ণতায় ভোগে। অনেক সময় আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
কারা ‘গ্যাসলাইটিং করে
– আত্মকেন্দ্রিক লোকজন
– যারা শৈশবে ও কৈশোরে শারীরিক, মানসিক বা যৌন নিপীড়নের শিকার।
– যারা সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি সন্দেহপ্রবণ
– যাদের মধ্যে আবেদনময়ী ভাব বেশী
– যারা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স বেশী।
এটা কীভাবে মানুষের উপর কাজ করেঃ
মানুষের কর্মক্ষমতা ও বিশ্বাস নষ্ট করে দেয়।
– আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ বা তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করার জন্য এটা করে থাকেন।
– অন্যকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এটা করে থাকেন
– কাউকে অবদমন করে রাখার জন্য।
– কারো আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে দেয়ার জন্য।
– প্রিয়জনের সবকিছুতে নজরদারি করা এটাও এক ধরণের মানসিক নির্যাতন।
–
গ্যাসলাইটিং এর উদাহরণঃ
– অন্যের সাথে তুলনা করা (সন্তানের ক্ষেত্রে)। পরিনতি অনেক সময় আত্মহত্যা।
– তোমার কিছুই মনে থাকেনা
-তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা
– তোমাকে দিয়ে একটা কাজও ঠিকভাবে হয় না।
এতে সন্তান অপমানিত বোধ করে ও হীনমন্যতায় ভোগে।
– তুমি বোকা তুমি দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। একটা কাজ ঠিকমতো করতে পারনা।
– মাথায় ঘিলু বলতে কিছু নাই
– মেয়ে মানুষের বুদ্ধি কম (এসব বলে তাকে ডাউন) করে দেয়া হয়।
– ছেলেরা এসব বিষয়ের কি বুঝবে
– স্পর্শকাতর কোন বিষয় নিয়ে হাস্যরস করা।
– কারো দুর্বল পয়েন্ট নিয়ে কথা বলে আঘাত করা
– কারো গায়ের রঙ, যোগ্যতা বা পেশা নিয়ে কথা বলা
পরিত্রাণ বা প্রতিকারের উপায়ঃ
নিজের উপর আস্থা রাখা
নিজেকে একা না করা
বন্ধু বান্ধবের সাথে থাকা
নিজের সফলতার কথা মনে রাখা, ভালো দিকগুলো চর্চা করা।
স্বামী/স্ত্রী/বাবা/মা/সন্তান/প্রেমিক/প্রেমিকা হলে কোন কারনে কষ্ট পাচ্ছেন তা বলে দেয়া।
ভালবাসার মানুষকে সম্মান করা, শ্রদ্ধাবোধ অটুট রাখা।
কর্মক্ষেত্রে ও অফিসেও অনেকের গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হন।
– কাজে বার বার ভুল ধরা
– পক্ষপাতিত্ব করা
– কাজের যথাযথ মূল্যায়ন না করা
– কাজে সুযোগ না দেয়া
এতে মনোবল নষ্ট হয়ে যায়। নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে। নিজেকে গুটিয়ে নেয়। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিষণ্ণতায় ভোগে।
লিখেছেনঃ আকেল হায়দার